অদ্ভুত-অপরাধ ও মনস্তত্ত্ব : অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী
নিউজ ডেস্ক
আপলোড সময় :
০৪-১১-২০২৩ ০৯:৪৫:৪৭ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
০৪-১১-২০২৩ ০৯:৪৭:৫৬ অপরাহ্ন
হত্যার রহস্য উদঘাটন: ২৮ অক্টোবর সকালটা একটু ভিন্ন ছিল। সারা দেশের মতো রাজনৈতিক উত্তাপ রাজশাহীতে ছিল না কিন্তু কিছুটা টেনশন ছিল । একটু আগেভাগেই ঘুম ভাঙলো গোদাগাড়ী সার্কেল এএসপি সোহেলের ফোনে, কাঁকনহাট পৌর এলাকায় একটা অজ্ঞাত লাশ পাওয়া গেছে।
১৫ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে বের হয়ে গেলাম, দূরত্ব ২০ কিলোমিটারের মতো। আধা ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গিয়ে এক মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে পেলাম ।
২৩ বছরের এক যুবককে গলায় দড়ি পেঁচিয়ে মাথা ফাটিয়ে অত্যন্ত নৃশংস কায়দায় খুন করা হয়েছে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার , তার ভ্যানের ব্যাটারি ছিনতাই।
ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই লাশের পরিচয় পাওয়া গেলো, তার পরিবারের সদস্যরা চলে এসেছিল, ইতঃমধ্যে খবর পাওয়া গেলো যে ঘটনাস্থল থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে হতভাগা ভ্যান চালকের ভ্যানটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে , ব্যাটারি নাই। খুন হয়ে যাওয়া ব্যক্তির নাম রিয়াজুল ইসলাম(২৩) বাড়ি রাজশাহী মেট্রো এলাকার দামকুড়া থানার শীতলাই এলাকায়। আপাতভাবে বোঝা যাচ্ছিল যে ভ্যানের ব্যাটারির জন্যই তাকে খুন করা হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা কোনো ইঙ্গিতই দিতে পারলো না।
পরিবারের সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার ছিল রিয়াজুলের বাচ্চাটার বয়স মাত্র দুই মাস। আহারে শিশুটি! জানবেই না বাবা কী জিনিস, বাবার আদর কী! মনটা খারাপ হয়ে গেলো, খুবই ! নিজের বাচ্চাদের মুখগুলো ভেসে উঠতে লাগলো!
অটোভ্যান ছিনতাই এর জন্য খুনের ঘটনা এখন বাংলাদেশে খুবই কমন এবং অনেক ক্ষেত্রেই ডিটেক্ট করা সম্ভব হয় না। আমাদের সামনে তেমন কোনো ক্লুও ছিল না। যাইহোক ডিজিটাল এনালগ সকল পদ্ধতি ব্যবহার করে কাজ শুরু করলাম। এসপি স্যারও কিছু নির্দেশনা দিলেন। সাথে আছে সার্কেল অফিসার সোহেল , তার মঙ্গল কামনা করি। একদিন সে বাংলাদেশ পুলিশের গর্ব হবে। ঘটনাস্থলে থাকতেই একটা শক্ত ক্লু পাওয়া গেলো। সোহেলকে নিয়ে কাঁকনহাট তদন্ত কেন্দ্রে চলে গেলাম। ক্লুটা আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিলো।
তদন্ত কেন্দ্রে গিয়ে আর কিছুক্ষণ কাজ করার পর আরিফ নামের একটা টার্গেট পেয়ে গেলাম, লোকেশন রাজশাহী শহরে।ভিক্টিমের বন্ধুস্থানীয়। ডিবি টিমকে বললাম আধা ঘণ্টার মধ্যে এই ছেলেকে আমার চাই। ওরা ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই টার্গেটকে আটক করে জানালো। আমরা রাজশাহী শহরে চলে এলাম। মাথার মধ্যে দুই মাস বয়সী বাচ্চাটার কথাই ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে। আটক আরিফকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো, সম্ভাব্য সকল উপায়ে তার মুখ খোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারছিলাম না। অভিজ্ঞ ইন্সপেক্টর সহকর্মীরাও ছিলেন।
এক পর্যায়ে সে জানালো দুজন ব্যক্তি পাঁচটা ব্যাটারি তাকে রাখার জন্য দিয়েছে। ডিবি টিম তার এক ভাইয়ের বাড়ি থেকে ব্যাটারিগুলো উদ্ধার করে নিয়ে এলো। কিন্তু, কে খুন করেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে সে ব্যাপারে কোনো তথ্যই সে দিলো না। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারনে তাকে আদালতে প্রেরণ করতে হলো, রিমান্ডের আবেদনসহ তাকে আদালতে পাঠানো হলো কিন্তু সময় না থাকায় দুইদিন পর শুনানির দিন ধার্য হলো।শুনানি শেষে বিজ্ঞ আদালত আটক আরিফকে তিন দিনের রিমান্ড দিলেন কিন্তু তাকে পাওয়া গেলো পরের দিন৷ জেল ফেরত রিমান্ডের আসামির মুখ খোলার নজির কম৷ রিমান্ডের আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ খুব সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়৷ উচ্চাদালতের নির্দেশনা মেনে জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকলো৷
আইও এসআই শাহেদ আলম অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিলেন৷ এক পর্যায়ে আরিফ আরেক জনের নাম বললো, তারই এলাকার সজিব, তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাকে আগেই সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছিল৷ ডিবির সহায়তায় তাকে শাহেদ আলম ধরে ফেললো৷ দুজন মুখোমুখি৷ কিন্তু, প্যাঁচ না খুলে আবার লেগে গেলো ৷ আরিফ বলে দুজনেই ছিলাম, সজিব বলে আরেক জন ছিল৷ গত রাতে সাকিল নামে সন্দেহভাজন আরেকজনকে আটক করা হলো৷
এবার জট খুলে গেলো৷ সবাই আমাদের কাছে প্রকৃত ঘটনা বলে দিলো৷ আলাদা ভাবে এবং একসাথে, উভয় বর্ণনা এক৷ ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ভ্যানচালক রিয়াজ আরিফের বন্ধু, দামকুড়া থেকে কাঁকনহাট পর্যন্ত একটা ভাড়ার জন্য রিজার্ভ করে সজিব এবং সাকিলকে তুলে দেয়৷ নিজে আরেকটা ভ্যান নিয়ে পিছে পিছে যায়৷ পথে ভিকটিম রিয়াজকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত ড্রিংকস খাওয়ায়৷ এক পর্যায়ে রিয়াজকে ফেলে ভ্যান নিয়ে চলে আসার সময় সে চিৎকার করে উঠে, তখন তিনজন মিলে মাথায় আঘাত করে এবং গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে ভ্যানের ব্যাটারি খুলে রাজশাহী শহরে চলে আসে৷
এই কাহিনির সবচেয়ে ইন্টারেসটিং বিষয় হলো আরিফের মুখ না খোলা৷
_____________________________________
আজ আদালতে পাঠানোর আগে যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এতো কিছুর পরও মুখ খোলোনি কেন? সে বলল, সাকিলের ছেলের মাথায় হাত রেখে কসম করেছিলাম, এই কথা কাউকে বলবো না৷ এক নিষ্পাপ শিশুর পিতাকে খুন করে আরেক নিষ্পাপ শিশুর পিতাকে রক্ষার চেষ্টা! মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝা কঠিন, সত্যই কঠিন৷
আজ৪/১১/২০২৩ আটক তিনজনই বিজ্ঞাদালতে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে৷ মাত্র ৪০/৫০ হাজার টাকার জন্য চারটা পরিবার ধ্বংসের মুখে৷ এসপি স্যারের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় এবং তত্ত্বাবধানে সার্কেল অফিসার সোহেল রানা, আইসি কাঁকনহাট করিম, এস আই শাহেদ, ডিবি টিম বিশেষত এস আই ইনামুল প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছে৷ দিনশেষে সন্তুষ্টি, এক নিষ্পাপ শিশুর পিতৃহত্যার বিচারের প্রাথমিক কাজ করতে পেরেছি৷
ধন্যবাদ বিচার বিভাগের কর্মকর্তা, বিজ্ঞ কোর্ট ইন্সপেক্টর এবং পুহেকো এর এলআইসি শাখাকে৷
ছবিতে মাঝে লাল গেঞ্জিতে সজিব, তার ডানে নীল জামায় সাকিল এবং বাকি জন মূল পরিকল্পনাকারী আরিফ৷
নিউজটি আপডেট করেছেন : Daily Sonali Rajshahi
কমেন্ট বক্স